রেকর্ড উৎপাদনে আশা জাগিয়েছেন ফেনীর কৃষকরা। নানা রকম উচ্চফলনশীল জাত, শিক্ষিতদের কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ, সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচি ও মাঠপর্যায়ে কৃষি বিভাগের তৎপরতায় বিগত তিন বছরে কৃষিতে উৎপাদন হয়েছে আশাপ্রদ। জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল ধান আবাদের পরিমাণ বেড়েছে ৪৬ শতাংশেরও বেশি। শুধু গত মৌসুমেই কৃষকরা উৎপাদন করেছেন পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি ফসল। উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা উৎপাদন খরচ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। বড় বাধা কৃষি শ্রমিকের সংকট ও উচ্চমূল্য।
সরেজমিন দেখা যায়, বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন। জমিতে ট্রাক্টরের চাষাবাদের ভটভট শব্দ। দল বেঁধে ধানের চারা রোপণ করছেন কৃষি শ্রমিকরা। ফেনীর ফসলি মাঠের পর মাঠে ফুটে আছে চলতি আমন রোপণে কৃষকদের কর্মযজ্ঞের চিত্র। এ যেন এক উৎসব।
ফেনী জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত তিন বছরে জেলায় উৎপাদন বেড়েছে প্রধান ফসল আমনে ৪৫ শতাংশ, বোরোতে ১৮ শতাংশ, সরিষায় ৯০ দশমিক ২০ শতাংশ, ভুট্টায় ৭২ শতাংশ, বাদামে ৬৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সূর্যমুখী ৬২ দশমিক ২২ শতাংশ ও সবজিতে ৩ শতাংশ।
তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরিষা আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৪ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৭৮৭ মেট্রিক টন। অন্যদিকে গত অর্থবছরে জেলায় সরিষা আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৩৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। এতে দেখা যায়, এক বছরে আবাদ ৯০ দশমিক ২০ শতাংশ ও উৎপাদন বেড়েছে ৯৩ শতাংশের বেশি।
কৃষি বিভাগ সূত্র আরও জানায়, ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় শীতকালীন সবজি আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ হেক্টর, যা আগের বছর ছিল ৫ হাজার ২১৪ হেক্টর। আবাদের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের মধ্যে চলতি মৌসুমে জেলায় চীনাবাদাম আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৫৯৮ হেক্টর, যা বিগত বছরে ছিল ৯৫২ হেক্টর। বছর ব্যবধানে আবাদ বেড়েছে ৬৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দেয়া মূল্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে কৃষিতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন চাল, প্রায় ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকার ২ লাখ ২৮ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন সবজি, প্রায় ২৪২ কোটি টাকার ৩০ হাজার ১৪৩ মেট্রিক টন তরমুজ, প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ৪ হাজার ৪৫৯ মেট্রিক টন গম ও ভুট্টা, প্রায় ২১৫ কোটি টাকার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন মসুর, ফেলন, খেসারি, মটর, সরিষা, সূর্যমুখীসহ ডাল ও তেলবীজ, ৫৭ কোটি টাকার ৩ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন আদা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদসহ মসলাজাতীয় ফসল।
জেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আবু হানিফ বলেন, ‘নানা সংকটে বিভিন্ন সময় জমিগুলো অনাবাদি থাকত। এখন প্রণোদনাসহ কৃষি বিভাগের পরামর্শমতো একই জমিতে ভিন্ন ভিন্ন ফসল আবাদ করছি। পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বিক্রিও করছি।’
জায়লস্কর ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের আরেক প্রান্তিক কৃষক কোব্বাদ আহাম্মেদ বলেন, ‘উৎপাদন বাড়লেও এখন রোগবালাই অনেক বেড়ে গেছে। জমিতে বারবার বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। খরচের সঙ্গে উৎপাদনের সামঞ্জস্য থাকে না। সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণহীন। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগ আরও সচেষ্ট হলে আমরা উপকৃত হব।’
অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘সরকার গত এক দশকে চাষের আধুনিকায়ন করেছে। আমাদের জলবায়ু অনুযায়ী বিশ্বমানের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জাত কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে শিক্ষিতরা কৃষিতে এখন অনেক আগ্রহী। কৃষিতে ভার্চুয়াল দুনিয়া ইতিবাচক একটা বড় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিতরা কৃষিতে যত বেশি সম্পৃক্ত হবে তত বেশি উন্নতি হবে। আবাদি জমি দিন দিন কমছে। তথ্ প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে উৎপাদন বাড়ছে। এখন আর বাপ-দাদার সনাতন পদ্ধতি নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না।’
ফুলগাজীর নিলক্ষী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক তমিজ মিয়া বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল আমাদের ফেনীর উত্তরাঞ্চলের যনম যনমের দুঃখ। দফায় দফায় ফসলহানি হয়। স্থায়ী সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এত দুঃখের পরও ফসল ফলিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের কারণে ফসলের ন্যায্যমূল্য পাই না। এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উগ্যোগও নেই। এভাবে চললে দিন দিন কৃষকের অনাগ্রহ তৈরি হবে।’
এবারের ফেনীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার বিজয়ী ও ফাজিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মজিবুল হক রিপন বলেন, কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকের জন্য প্রণোদনা, সার, বীজ, চারা, কৃষিঋণসহ অনেক ভর্তুকি দিচ্ছে। এসব বিতরণে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রকৃত কৃষকরা সুবিধা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগকে কঠিন তদারকির পরামর্শ তার।
ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক একরাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক কৃষকদের অনেককেই বিনা মূল্যে সার, বীজ, ফলদ চারা বিতরণ করছি। প্রান্তিক পর্যায়ে বৈঠক, সভা ও কর্মশালার মাধ্যমে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, রোগবালাই, ব্যবস্থাপনাসহ তথ্য দেয়া হচ্ছে।’
প্রণোদনা বিতরণের স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমিত জনবল নিয়েও আমরা কর্মক্ষেত্রে সবাই সচেষ্ট। প্রণোদনা বিতরণের ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় তাদের যে প্রভাব থাকে না, এটা বলা যাবে না। অভিযোগ বা খবর পেলে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি।’
প্রসঙ্গত, ফেনী জেলায় ৬৯ হাজার ৫৫৩ হেক্টর আবাদযোগ্য জমিতে আবাদের সঙ্গে জড়িত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৯৩ জন। ২০২০ সালে চালু হওয়া সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে এদের মধ্যে এ পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৩৩টি কম্বাইন হারভেস্টার (ধান কাটাই-মাড়াই-বস্তাবন্দি এক যন্ত্রে), ৩২টি সিডার (বীজ বপন যন্ত্র), ২৭টি পাওয়ার থ্রেসার (ঝাড়াই যন্ত্র), ১৪টি রিপার (ধান কাটার যন্ত্র) ও রিপার বাইন্ডার (আঁটি বাঁধার যন্ত্র), ৫টি বেড প্ল্যান্টার, ২টি করে পাওয়ার স্প্রেয়ার ও উইডার।
0 Comments