‘আইনমন্ত্রীর ভিসা বাতিল করেছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট’—আবদুর রব ভুট্টো নামের এক ব্যক্তি গত জুলাই মাসে ফেসবুকে এমন একটি পোস্ট দেন। এক দিনেই এটিতে লাইক ও কমেন্ট পড়ে হাজারের বেশি। এর কয়েক দিনের মধ্যেই আরেক মন্ত্রীর নাম দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা ছড়ানো হয়, ‘আমেরিকা যাওয়ার জন্য বিমানে চড়ার আগে তার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। পরে তিনি ভারতে চলে যান।’ পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুটি তথ্যই ‘ভুয়া’।
এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইংরেজিতে লেখা এক টুকরো কাগজের ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে লেখা—‘একাধিক মামলায় আদালতের দেওয়া কারাদণ্ড নিয়ে যুক্তরাজ্যে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
গত ২২ জুলাই ‘আবাবিল টিভি টোয়েন্টিটু’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।’ ভিডিওটির ধারা বিবরণীতে দাবি করা হয়, ‘ইউএস ফরেইন সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন টুইট করেছেন, বিশেষ ল আনছেন তারা, ভিসা রেস্ট্রিকশন আনছেন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে।’
অবশ্য ফ্যাক্ট চেক (সত্যতা যাচাই) করে দেখা গেছে যে, ওই তারিখে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের কোনো টুইট করা হয়নি।
এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে একের পর এক গুজব। জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন জেঁকে বসছে গুজবের ভূত। এই গুজব যেমন নির্বাচন এবং নির্বাচনী কার্যক্রমে যুক্ত পুলিশ, র্যাবসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ঘিরে; তেমনি সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কেও ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দলের নেতারাও রেহাই পাচ্ছেন না ভয়ংকর গুজব আর অপপ্রচার থেকে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা এবং পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তাকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ও ছবি দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, ‘আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তারা দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না।’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘মনোবল ভেঙে দিতে নানা সময়েই অপপ্রচার ও গুজবের টার্গেট হয়েছে পুলিশ। এটি পরিকল্পিতভাবেই করে স্বার্থান্বেষীরা; কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। যতই চেষ্টা করা হোক, সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ভাঙা সম্ভব নয়। অর্পিত দায়িত্ব পালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পিছপা হয় না, সে সুযোগও নেই।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো কর্মী নিজেদের ফেসবুক আইডি, পেইজ বা গ্রুপ থেকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেক গুজব ছড়াচ্ছেন, পাশাপাশি ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ফেসবুক গ্রুপ, পেইজ বা ইউটিউব এবং টিকটকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব গুজবে ব্যক্তি আক্রমণ থেকে শুরু করে দলগতভাবেও আক্রমণ করা হচ্ছে।
সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৭৪টি সাইবার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যায়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এর অনেক অপপ্রচার ও গুজব ছড়াতে কাজে লাগানো হচ্ছে। পুরোনো অনেক ভিডিও, লাইভ ভিডিও রয়েছে, সেগুলো নিজেদের স্বার্থে অ্যাপের মাধ্যমে ভয়েস বসিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, পুরোনো লাইভ—যেটি বিকেলে করা হয়েছিল, সেটি এখনকার দাবি করে সকালে দেখানো হচ্ছে, যেটি শীতের মৌসুমে করা হয়েছিল, গুজব ছড়াতে সেটি গরমকালে বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটি ব্যক্তি এবং কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে করছে।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় পুলিশ দায়িত্ব পালন করে আসছে। সংঘাত প্রতিরোধে আগাম গোয়েন্দা নজরদারি, রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা ঠেকানো এবং তা ঘটে গেলে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশ কাজ করে থাকে। এসবের বাইরে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে গুজব। জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই গুজব ততই ডালপালা ছড়াচ্ছে। ব্যক্তি, দল ছাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে গুজবের ডালপালা যে বড় করে ছড়াবে, সেই আভাস পেয়েছে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও। তাই এই গুজবের ভূত তাড়াতে নড়েচড়ে বসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে ফেসবুকের তিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ফেসবুকে যে ধরনের অপপ্রচার হয়, সেগুলো কীভাবে রোধ করা যায়, সে বিষয়ে তাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, সাম্প্রদায়িকতা বা ফেসবুকের নীতি ভঙ্গ করে, সে ধরনের অপপ্রচার থাকলে তারা তা ডিলিট করবে, ব্লক করবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন কালবেলাকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে স্বার্থানেষী মহল নানা গুজব ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এরা টার্গেটবেজ অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই গুজব সৃষ্টিকারীদের বিষয়ে র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করছে।’
তিনি বলেন, ‘যেসব আইডি, গ্রুপ বা পেইজ থেকে গুজব বা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করছেন র্যাবের সাইবার টিমের সদস্যরা। এসব আইডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) ডিসি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন কালবেলাকে বলেন, ‘দেশে গুজব বা অপপ্রচার বছরের পর বছর ধরেই চলে আসছে; কিন্তু এটি এখন সাইবার স্পেস ব্যবহার করে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তবে সাইবার পুলিশের সদস্যরাও বসে নেই। এসব গুজব ও অপপ্রচার ঠেকাতে সাইবার পুলিশ নিয়মিত সাইবার মাধ্যমে টহল দিচ্ছে।’
গুজবের ভূত তাড়াতে নজরদারিতে সহস্রাধিক পেইজ: সাইবার পুলিশ সূত্র বলছে, সাইবার স্পেসে টহল দিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি ল্যাব, সিটিটিসির একটি ল্যাব, সিআইডির ল্যাব, র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল থেকে নিয়মিত সাইবার টহল দেওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্তত এক হাজার আইডি, পেইজ ও গ্রুপ শনাক্ত করা হয়েছে—যেগুলো সরকার ও রাষ্ট্র, দল ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ওইসব পেইজের মধ্যে ১৫০টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক ভয়াবহ গুজব ছড়াচ্ছে এবং অপপ্রচার চালাচ্ছে। এগুলো বন্ধে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
গত তিন মাসে এ ধরনের অন্তত ৭১০টি ফেসবুক আইডি, পেইজ ও গ্রুপ যথাযথ নিয়ম মেনে বন্ধ করা হয়েছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইন কালবেলাকে বলেন, সাইবার স্পেসে পরিকল্পিতভাবে গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানো হয়। অনেক সময়ে এগুলো বন্ধে সময় লেগে যায়। সুইসাইড, যৌন হয়রানি বা দাঙ্গা ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে—এমন গুজব ও অপপ্রচার সম্পর্কে অভিযোগ দিলে ফেসবুক তাদের নিয়ম মেনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। রাজনৈতিক গুজবের বিষয়ে আইডিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক প্রমাণ হাজির করতে হয়। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে নির্বাচনের আগে গুজব সৃষ্টিকারীরা।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং জি-মেইল কর্তৃপক্ষের কাছে নানা অভিযোগ দেওয়া হলেও যথাযথ সময়ে (রিয়েল টাইম) তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে না।
দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো হয় ৩০ শতাংশ গুজব: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, গুজব বা অপপ্রচারে ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি ও পেইজ এবং অন্যান্য সাইবার স্পেসে নজরদারি করে দেখা গেছে, এর অন্তত ৩০ ভাগ দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো হচ্ছে। কিছু কিছু সাইবার আইডি রয়েছে, এগুলো শুধু গুজব আর অপপ্রচার করতেই তৈরি করা হয়েছে। এরা পেশাদার গুজব সৃষ্টিকারী।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের বাইরে অবস্থান করায় এই ৩০ ভাগ গুজব সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অনেকের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে মামলা হলেও তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে তারা প্রতিনিয়তই গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে।’
অবশ্য র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিদেশ থেকে গুজব ও অপপ্রচার সৃষ্টিকারীদের দেশের ভেতর থেকে কেউ কেউ তথ্য ও কনটেন্ট দিয়ে সহায়তা করে। তাদের চিহ্নিত করে র্যাব ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে ছড়ানো গুজব ও অপপ্রচারের কনটেন্টগুলো দেশে অবস্থানকারী অনেকে না জেনেই লাইক বা শেয়ার দিয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ছেন। তাই সবার যাচাই করা উচিত, যা শেয়ার দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক কি না।’
সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলছেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এমন একটি সাইট তৈরি করা উচিত, যেখানে ভুয়া বা গুজব সৃষ্টিকারী কনটেন্টগুলোর বিরুদ্ধে আসল ঘটনার কনটেন্ট থাকবে। তাহলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে কোনটা আসল এবং কোনটা ভুয়া বা গুজব। এতে গুজবকারীদেরও চিনতে পারবে মানুষ।’
অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ও যন্ত্র কেনার প্রস্তাব: সাইবার পুলিশ ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুজব সৃষ্টিকারীরা অত্যাধুনিক সব অ্যাপস ব্যবহার করছে। এতে অনেক সময় তাদের সাইবার স্পেসে নজরদারি করা যায় না। তা ছাড়া নজরদারির মধ্যে পড়লেও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কনটেন্টগুলোও দ্রুত অপসারণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য নির্বাচনের আগে এসব গুজব ঠেকাতে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ও যন্ত্র কেনার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গত মাসে মন্ত্রণালয়ের সাইবার মনিটরিং সেলের এক বৈঠকে তারা কিছু সফটওয়্যার ও টুলস কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তা ছাড়া সাইবার পুলিশে দক্ষ জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনের আগে যতদূর সম্ভব এই ঘাটতি পূরণের অনুরোধ করা হয়েছে।
0 Comments